আমি এই প্রথম তার লিখা পড়লাম, পুতুলনাচের ইতিকথা বইটি ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
‘গাওদিয়া’ নামে ছোট্ট একটা গ্রামকে ঘিরে এই উপন্যাস গড়ে উঠে। যেখানে মানুষের জীবন খুব সহজ সরল, ধর্মীয় কুসংস্কারে আর কলঙ্ক রটানোতে লিপ্ত হয়ে যাদের দিন কাটে। উপন্যাসের মূল চরিত্র শশী, যিনি সেই গ্রামের ডাক্তার। এক হিসেবে এই উপন্যাস শশী ডাক্তার এর কাহিনীই। হারু ঘোষের মৃত্যু দিয়ে উপন্যাস শুরু হয়, উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র সমুহ- কুসুম, পরান, মতি, কুমুদ, গোপাল, যামিনী কবিরাজ, তার বৌ সেনদিদি, যাদব পণ্ডিত, পাগলদিদি ইত্যাদি।
শশী ডাক্তারের মানসিকতা আর তার জন্মদাতা পিতার মানসিকতার সাথে কোন মিল নেই, তারা দুজন যেন দু’মেরুর মানুষ, তাই শশী প্রায় সময় গ্রাম ছেড়ে দূর শহরে চলে যেতে চায়, যেখানে সে নিজের মতো করে নিজের জগৎ সাজিয়ে থাকতে পারবে। উপন্যাসে শশীর এক বন্ধু হুট করে তার বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় আর হুট করেই তার গ্রামের এক মেয়েকে বিয়ে করে নিজের মতো বানিয়ে সময় আর জীবনের খেলায় গা ভাসিয়ে দেয়। উপন্যাসটি পড়ার পর অনেকের কাছে শশীর চেয়ে তার বন্ধুর চরিত্রটা বেশি ভালো লাগে। পুরো গ্রামে এতো গুলো মানুষের মাঝ থেকে শশীর একমাত্র মনের মানুষ, পরানের বউ কুসুম, যে তার সব কথা বুঝে, তাকে আপনজন হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু শশী কুসুমের জন্য যেন কিছুই করতে পারে না এমন কি তার মনের কথা গুলোও বুঝে না, শুধু বুঝে কুসুমের সাথে কথা বলতে তার ভালো লাগে। উপন্যাসের এক পর্যায় যাদব পণ্ডিত ও পাগলদিদি দুজনের একসাথে স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ উপন্যাসটিকে অনেকটা রহস্যময় করে তুলে। সময়ের প্রয়োজনে মৃত যাদব পণ্ডিতের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছে পূরণ কাজে শশী এতোটা ব্যস্ত হয়ে যায় যে কুসুমের কথা কি ! নিজের কথা, এমনকি নিজের দূরদেশ চলে যাওয়ার কথা সে ভুলে যায়।
উপন্যাস এর কাহিনী অনুযায়ী লেখক নামকরণ করেছেন কারণ হারুর মৃত্যু থেকে কুমুদ-মতির বিয়ে এবং যাদব পণ্ডিত আর তার বৌয়ের মৃত্যু থেকে কুসুমের গ্রাম ছেড়ে দেওয়া, প্রত্যেকটা পর্যায়ে শশীর মনে হতে থাকে মানুষের উপর একটা শক্তি কাজ করছে যার কাছে আমরা সবাই পুতুল, তার সুতোর টানে আমাদের জীবনের এতো পরিবর্তন, জীবন নিয়ে এতো খেলা আমাদের চারপাশে।
লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসটিতে তুলে ধরতে চেয়েছেন-ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রেম, বিরহ, দ্বেষ ও পারস্পরিক সহমর্মিতা।
সব মিলিয়ে উপন্যাসটি আমার কাছে খুবই চমৎকার লেগেছে কারণ এই বইটি যে বাংলা সাহিত্যের সম্পদ তা বইটি পড়েই বুঝা যায়। তাই যারা এখনো বইটি পড়েন নাই তারা অবশ্যই ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ এর লিখা ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ বইটি সংগ্রহ করে পড়ে ফেলুন।
শুভ হোক আপনার পাঠ্য কার্যক্রম।